গল্পঃ কোরবানির শান্তগরু | কবির কাঞ্চন


এইমাত্র স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছি। বাসার সিঁড়িতের পা
রাখতেই আমার একমাত্র ছেলে সাঈদের দিকে দৃষ্টি পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম। ওর চোখেমুখে আনন্দ। খুব ব্যস্ত সময় পার করছে। উঠোনে তিনটি গরু আছে। লালগরু, সাদাগরু ও কালোগরু। আমাদের পাশের বাসার লোকেরা কোরবানির উদ্দেশ্যে গতকাল কোরবানির হাট থেকে কিনে এনেছেন।


গতকাল রাত থেকে সাঈদের দৌড়াদৌড়ি বেড়ে গেছে। রাতে ঘুমোতে যাবার কালে ও বারবার জিজ্ঞেস করেছে। কখন আমাদের গরু কিনবে, বাবা। কালকে নিয়ে আসো না। সবাই গরু নিয়ে এসেছে। শুধু আমাদের গরুটা------। 
এই কথা বলে মন খারাপ করে বালিশে মুখ লুকিয়ে রাখে। আমি আলতো করে ধরে ওর মুখে, কপালে চুমো খেয়ে বললাম,
- আর মন খারাপ করতে হবে না। আগামীকালই আমাদের কোরবানির গরু কিনব।
সাঈদ মুখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
- আমায় নিবে না, বাবা?
আমি বিস্মিত চোখে বললাম,
- কোরবানির গরু কিনতে হাটে যাবো। আর আমার বাপজানকে সাথে নেবো না। এ কি হয়!
সাঈদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে আমার কপালে চুমো খেয়ে বলল,
- ধন্যবাদ, বাবা। এ জন্যই তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। 
ওর মুখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে আমার খুব ভালো লাগে।
এরিমধ্যে আমার স্ত্রী সবকিছু গুছিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। আমাদের দিকে কৌতুক চোখে তাকিয়ে বলল,
- কি ব্যাপার! বাবা-ছেলে এতক্ষণ ধরে কিসের সলাপরামর্শ করছো?
আমি উত্তরে বললাম,
- তোমার ছেলে কোরবানির গরু কিনতে বায়না ধরেছে। 
- ঠিকই তো। আরমাত্র দুইদিন পর কোরবানির ঈদ। সবাই গরু কিনে নিয়েছে। সাঈদকে তো গরুর কাছ থেকে আনতেই পারি না।
- কী করবো, বল। বাড়ি থেকে আব্বা আম্মা আসছেন।আগামীকাল আনুমানিক দুপুর বারোটার মধ্যে পৌছবেন। আব্বাকে সাথে নিয়ে গরু না কিনলে যদি আবার মন খারাপ করেন।
আমার স্ত্রী সায় দিয়ে বলল,
- হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছো। আমি তো ভুলেই গিয়েছি। বাড়ি থেকে আব্বা আম্মা আসছেন। 
দেয়ালঘড়িটার দিকে চোখ পড়তেই আমি ব্যস্ত গলায় বললাম 
- ওহ্!  মাই গড। রাত একটা বেজে গেছে। আর কোন কথা নয়। এসো ঘুমিয়ে পড়ি। 
বালিশে মাথাটা রাখতেই দেখি আমার ছেলে এসে আমার বুকে তার জায়গা করে নিয়েছে। ওর জন্য আলাদা বালিশ থাকলেও ও আমার বালিশের কিছু অংশ ভাগাভাগি করে সন্তুষ্ট থাকবে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ক্লান্ত শরীরে অল্প সময়ের মধ্যে সবার চোখে ঘুম এসে যায়।

ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওকে উদ্দেশ্য করে ডাক দিয়ে বললাম,
- সাঈদ, আব্বু, এদিকে এসো। 
আমার গলার আওয়াজ পেয়ে সে এক দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
আমি ভালোভাবে ওকে লক্ষ্য করি। ওর কপালে এবং গালে ঘাম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। 
আমি আবেগী হয়ে বললাম,
- এখন চল আমার সাথে। 
- না বাবা, তুমি বাসায় যাও আমি একটু পর আসছি।
- এখন আবার কি করবে?
- আমি এখনও সাদাগরুটার সাথে কথা বলিনি। ও রাগ করবে না?
- গরুর সাথে কথা! 
এই বলে আমি হো হো করে হেসে উঠি। সাঈদ নির্বোধের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। 
আমি ওর হাত দুটো ধরে বাসার দিকে নিয়ে আসি। 
ও আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
- আচ্ছা, বাবা, তুমি ওভাবে হো হো করে হাসলে কেন? আমি কি হাসার কিছু বলেছি?
- হ্যাঁ, বলেছো। তুমি প্রথমে বললে গরুর সাথে কথা বলেছো। আবার বললে সাদাগরুটি নইলে রাগ করবে। তাই হেসেছি।
সাঈদ চোখ কপালে তুলে বলল,
- লালগরু ও কালোগরুর সাথে কথা বলেছি। সাদাগরুটি তো পাশে ছিল। ও তো নিশ্চয় দেখেছে। সবাইকে আদর করলাম ও কি দোষ করেছে! ওকেও তো কোরবানি দেয়া হবে। তুমিই তো মাঝেমধ্যে বল, জীবদের জীবনে আশা থাকে। কোনকিছু  আশানুরূপ না হলে জীবরা রাগ করে বসে। তাহলে সাদাগরুটার মনেও তো একটু আনন্দ পাওয়ার আশা জাগতে পারে। সেদৃষ্টিতে তার রাগ করাটা স্বাভাবিক।
আমার এতটুকুন ছোট্ট ছেলের কাছ থেকে এমন উত্তর পেয়ে আমি খুব খুশি হয়ে যাই। এরপর ওর কথায় সায় দিয়ে বলি 
-  ঠিক আছে, বাবা। এখন বল, তুমি কেমন গরু নিতে চাও?
-  আমরা শান্ত গরু কিনবো, বাবা।
-  শান্ত গরু মানে!
-  জানো বাবা, মিলিদের লালগরু আর শেলীদের কালোগরুটা খুব পাজি। ওদের কাছে যাওয়াই যায় না। ওদের কাছাকাছি গেলে শিং নিয়ে তেড়ে আসে। ভাগ্যিস শক্ত করে বাঁধা ছিল। নইলে------। কিন্তু বুবলিদের সাদাগরুটা খুব ভালো। কাছে গেলে এমনকি গায়ে হাত দিয়ে আদর করলেও রাগ করে না। বাবা, আমি সাদাগরু কিনবো।
এতক্ষণে আমি বুঝলাম কেন ও শান্তগরুর কথা বলছে। তারপর ওকে আশ্বস্ত করে বললাম,
- আচ্ছা, বাবা তোমার পছন্দের শান্তগরুই কিনবো। এখন চল। খেতে  যাই। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে  তোমার দাদাদাদি বাসায় এসে পৌঁছবেন। তোমার দাদার সাথে আমরা বিকেল চারটায় গরু কিনতে বের হবো।
এমন সময় বাইরে থেকে খকখক কাশির আওয়াজ পেয়ে সাঈদ "দাদা! দাদা!" বলে আনন্দে দৌড় দেয়। আমি আর আমার স্ত্রীও ওর পিছেপিছে প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে আসি। 
অনেকদিন পর আব্বা-আম্মাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলি। ততক্ষণে আমার ছেলে আমার চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত হয়ে গেল। 
বাবা-মা ফ্রেশ হয়ে এলে সবাই মিলে মজা করে দুপুরের খাবার খেলাম। আমার আব্বা-আম্মাকে পেয়ে সাঈদ যেন আবার স্বর্গেরসুখ ফিরে পেয়েছে। ওর এমন উচ্ছ্বাস দেখে স্মৃতির রোমন্থনে আমিও ভিতরে ভিতরে উচ্ছ্বসিত হই। আবার এক মুহূর্ত পর বেদনার নীলে একাকার হই। আমি তো আজও আছি। কিন্তু নেই শুধু আমার স্বর্গসুখের সাথী দাদা-দাদি। 

বিকেল চারটায় আমরা গরু কেনার জন্য বাসা থেকে বের হই। বিশাল গরুর হাটের এদিকওদিক পায়চারি করি। পছন্দের গরুকে খুঁজতে থাকি। হঠাৎ সাঈদ একটি সাদাগরু দেখিয়ে বলল,
- বাবা, এই গরুটা মনে হয় শান্ত হবে। কিনে নাও।
আমার বাবা গরুটির কাছে গিয়ে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন। 
এরপর একবার সাঈদের দিকে এবং একবার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে গরুর মালিকের সাথে দাম নিয়ে কথা শুরু করলেন। প্রায় দশমিনিট আলাপচারিতার পর ৬৫ হাজার টাকা মূল্যে গরুটি কেনা হলো। 
সাঈদ গরুটির কাছে এসে গরুটির গায়ে আদুরে হাত রাখতেই গরুটি "হাম্বা! হাম্বা!" করে আওয়াজ করতে লাগলো। 


পরিচিতি ও যোগাযোগ :
কবির কাঞ্চন
সহকারী শিক্ষক 
বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজ চট্টগ্রাম
সিইপিজেড, চট্টগ্রাম 
যোগাযোগ - ০১৬৭৩৯০৩৫০৩
                    ০১৯৬০০৯০৭৭৬
email: kabirctg1985@gmail.com
‎ফেসবুক : কবির কাঞ্চন


Comments

Popular posts from this blog

শিশুতোষ গল্পঃ রাজকন্যা ও ব্যাঙ | মোনোয়ার হোসেন

খোকা আঁকে | তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন

গল্প : পিতার আর্তনাদ | কবির কাঞ্চন