গল্প : পিতার আর্তনাদ | কবির কাঞ্চন
আরজু আহমেদ। জন্ম নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানায়।
ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট করে পড়াশুনা করেছেন। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশুনা শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হবেন। কিন্তু পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক নানান প্রতিকূলতার কারণে তার বুকের লালিত স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হয়নি। শেষমেশ একটি বেসরকারি ব্যাংকেই তার চাকরি হলো।চাকুরির একবছর যেতে না যেতেই বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হতে হলো তাকে। একটুও ঠকলেন না আরজু সাহেব। সুন্দর ভালো মনের একজন সাংসারিক বৌ পেলেন। দু’বছরের মাথায় তাদের সুখের সংসারে আলো ছড়িয়ে প্রথম পুত্রসন্তানের আগমন ঘটলো। একমাত্র ছেলে হিমেলকে পেয়ে আরজু আহমেদ, হিমেলের দাদা-দাদী খুব খুশি হলেন। ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন আরজু সাহেব। একদিন হিমেল অনেক বড় হবে। বিসিএস ক্যাডার হয়ে তার মনের অপূর্ণতা দূর করবে।
হিমেল সেপথেই বড় হচ্ছে। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তারপর নিজের কর্মস্থলের পাশে, শহরের একটি নামকরা কলেজে হিমেলকে ভর্তি করানো হয়। বাবা-ছেলে এককক্ষ বিশিষ্ট ছোট্ট একটি ব্যাচেলর কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলো।
আরজু আহমেদ ছেলের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেন। ছেলের কাছে তার চাওয়ার কথা বলেন। হিমেলও বাবার কাছে সব বিষয় শেয়ার করে। লেখাপড়াকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন মনে করে নিয়মিত পড়াশুনা করে চলেছে। সকালে বাবার সাথে হিমেল কলেজে যাবার উদ্দেশ্য কলেজ ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়। মাঝপথে ছোট্ট কোন খাবার হোটেলে বাবা -ছেলে একসাথে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। তারপর হিমেল বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলেজের দিকে চলে যায়। কলেজ শেষে বাসায় ফিরে এসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করার পর আবার প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। সন্ধ্যা নামার আগে আগে বাসায় ফিরে আসে সে। মাগরিবের নামাজ আদায় করে পড়ার টেবিলে বসে যায়। অফিস থেকে বাবা ফিরলে দুজনে একসাথে হালকা নাস্তা করে নেয়। এরপর হিমেল আবার পড়তে বসে। হিমেলকে এভাবে পড়াশুনায় মগ্ন থাকতে দেখে আরজু আহমেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন।
একদিন হিমেল বাবাকে কল করে বলল,
"বাবা, আমি কলেজ থেকে বের হচ্ছি। এইমাত্র কলেজ ছুটি হয়েছে। আজ তোমার জন্য আমার একটা চমক আছে, বাবা।"
- কিসের চমক!
- তোমার অফিসের দিকে আসছি। এসেই তোমাকে চমকে দেবো। তুমি খুব খুশি হবে, বাবা। তোমার স্বপ্ন---- না থাক। সামনাসামনি দেখিয়ে বলব।
- ঠিক আছে, বাবা। সাবধানে আসিস।
- জ্বি বাবা, চিন্তা করো না। তোমার ছেলে তোমার কাছে খুব শীঘ্রই ফিরছে।
আরজু আহমেদ প্রাণভরে হাসলেন। মোবাইলের কল কেটে দিয়ে আনমনে ছেলেকে নিয়ে ভাবতে লাগলেন। নিজের অজান্তে কয়েক ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে।
হিমেল ও তার কয়েকজন বন্ধু কলেজ গেইট পার হয়ে ধীরে ধীরে প্রধান সড়কের দিকে চলে আসে। প্রতিদিনের মতো আজও বাসস্ট্যান্ডে বাস ধরার জন্য পায়ে হাঁটতে থাকে। একে অন্যে গল্প করতে করতে প্রায় বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি চলে আসে ওরা। হঠাৎ করে পিছন থেকে ক্ষীপ্র বেগে ছুটে আসা অনিয়ন্ত্রিত একটি বাস রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠে আসে। হিমেল বাসটির নিচে পড়ে যায়। স্পটেই তার মৃত্যু ঘটে। অন্যরা কোনমতে আত্মরক্ষা পায়। কয়েকজন গুরুতরভাবে জখম হয়। ভীড়ের মাঝে গাড়িচালক ও গাড়ির হেলপার পালিয়ে যায়। গাড়ির যাত্রীদের অনেকেই গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মুহূর্তে আশপাশের লোকজন হিমেল ও আহতদের নিকটবর্তী হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার হিমেলের দেহ পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যান্যদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা দিতে থাকে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হিমেলদের কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা ছুটে আসেন। হিমেলের গাইড টীচার অনিমেষ পাল হিমেলের বাবাকে কল করে হাসপাতালের দিকে আসতে বলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আরজু আহমেদ হাসপাতালে এসে পৌঁছলেন।
চোখের সামনে নিজের ছেলের রক্তাক্ত লাশ দেখে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। হঠাৎ হুশ হারিয়ে ফেলেন। উপস্থিত সবাই তাকে ঘিরে আছে। সবার চোখে জল। কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরে এলে ছেলের লাশের কাছে গিয়ে বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন,
"এই বুঝি তোমার চমক, বাবা! তোমার এমন রক্তে রঞ্জিত দেহ দেখে তো আমি চমকিত হতে চাইনিরে মানিক.............।
আমি তো তোমার চমক একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি। উফ! যদি পারতাম----------। এখন তোমার মায়ের কাছে এ সংবাদ আমি কিভাবে দেব!
হে আল্লাহ! এ কি হয়ে গেল! আমার সারাজীবনের তিলে তিলে গড়া স্বপ্ন তুমি কেন ছিনিয়ে নিলে? পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ তুলে দেবার আগে কেন আমার মরণ দিলে না!"
এই বলে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
হিমেলের কলেজের শিক্ষকরা তার বাবাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। অনিমেষ স্যার আর্দ্র গলায় বললেন,
- আজ আপনাকে সান্ত্বনা দেবার মত কোন ভাষা আমাদের জানা নেই। তবু এ। কথা বলবো, ধৈর্য্য ধারণ করুন। ভগবানকে স্মরণ করুন। তাঁর ইচ্ছার ওপর কারো হাত থাকে না।
আরজু আহমেদ কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,
- তাই বলে আমার ছেলেকে অকালে নিয়ে যাবে! ও কি অপরাধ করেছে? ওই তো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র স্বপ্ন ছিল। এখন সেই স্বপ্নকে হারিয়ে আমি কি নিয়ে বাঁচবো, স্যার?
এই কথা বলে তিনি অনিমেষ স্যারের বুকে মাথা রেখে সন্তান হারানোর নিদারুণ কষ্টে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।
মুহূর্তে পুরো হাসপাতাল এলাকায় যেন শোকের ছায়া নেমে আসে।
এমন সময় পাশ থেকে একজন পথচারি ভীড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে এসে হিমেলের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- আপনার ছেলের পাশে এই ব্যাগটি পেয়েছি। এই নিন।
আরজু আহমেদ ব্যাগটা হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরে কাঁদো গলায় বলতে থাকেন,
"আল্লাহ গো! আমার আগে কেমন করে আমার বুকের মানিককে নিয়ে গেলা!"
উপস্থিত সবাই তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর পরম কৌতুহলী হয়ে ব্যাগের চেইনটা খুলতেই তার চোখে পড়ে হিমেলের' ফার্স্ট ইয়ার ফাইলান পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড'। রিপোর্ট কার্ডটি হাতে নিয়ে ঝটপট পড়তে লাগলেন। হিমেল ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
এরপর কার্ডটি দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে অঝরে কাঁদতে লাগলেন।
ততক্ষণে হাসপাতালের বাইরে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আন্দোলনকারীদের কন্ঠে উচ্চস্বরে ধ্বনিত হতে থাকে, "হিমেল হত্যার বিচার চাই। নিরাপদ সড়ক চাই।"
পরিচিতি ও যোগাযোগ :
কবির কাঞ্চন
সহকারী শিক্ষক
বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজ চট্টগ্রাম
সিইপিজেড, চট্টগ্রাম
যোগাযোগ - ০১৬৭৩৯০৩৫০৩
০১৯৬০০৯০৭৭৬
email: kabirctg1985@gmail.com
ফেসবুক : কবির কাঞ্চন
Comments
Post a Comment