গল্পঃ ফাহিমার স্বপ্ন | মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর

ঘরের জানালা খুলে দাঁড়ালেন ফাহিমা। তাকালেন নীলিম আকাশের পানে। আপন মনে দেখছেন বিশ্বপ্রকৃতি। দেখছেন নীল আকাশ। সবুজ বনানী। দেখছেন গাছগাছালি। সবুজের মাঠ। ধানের খেত। সরষে ফুলের হাসি। প্রজাপতির উড়াউড়ি। পাখিদের নাচানাচি। দোয়েলের শীষ দোলানো নৃত্য। শিশিরভেজা দূর্বাঘাস। খালি পায়ে হেঁটে চলা টোকাই। ছেঁড়া জামা গায়ে এগিয়ে চলা পথশিশু। শীতে কাঁপছে ওদের কচি দেহ। কোমল প্রাণ। তবুও জীবনের তাগিদে এগিয়ে চলছে ওরা। সামনে। ক্রমাগত লক্ষ্যপানে। এসব দেখছেন ফাহিমা। একান্ত আপন মনে। আপনার করে। দেখছেন আর ভাবছেন। ভাবছেন আর হারিয়ে যাচ্ছেন অন্য জগতে। অন্য ভুবনে। বিবেক তাড়িত জমিনে। আহত আত্মার বিচরণ মাঠে। মাঠকর্মী হয়ে।

আবারও বাইরে তাকালেন ফাহিমা। চোখ গিয়ে পড়ল রাস্তায়। মানুষের হেঁটে চলা জমিনে। মেঠোপথে। দেখলেন আরেকজন টোকাই হাঁটছে। গায়ে ছেঁড়া জামা। পায়ে নেই জুতো। এই কঠিন শীতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। যোদ্ধাবেশে। যোদ্ধা সেজে। জীবনের তাগিদে। প্রয়োজন পূরনে। মানবতা রক্ষায়। জীবন বাঁচানোর জন্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। ওকে দেখে হোঁচট খেলেন ফাহিমা। আর স্বাভাবিক থাকতে পারলেন না তিনি। বিবেক তাড়িত হলেন খুব বেশি। অনেক কষ্ট পেলেন মনে। মনের গহীণে একটা মোচড় মেরে উঠলো। অনেক কষ্টের মোচড় সেটা। অনেক বেদনার সে মোচড়ানী। ফাহিমার মনে পরল তার হারিয়ে যাওয়া আমীনের কথা! স্বামীর কথা! সুখের সংসার ছিল তাঁর। বিয়ের তিন বছর পর কোলজুড়ে এসেছিল আমীন। হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে গড়তেছিল আমীনকে। মানুষের মতো মানুষ কর গড়ে তোলার প্রত্যয় ছিল ফাহিমার। কিন্তু একটি ঝড় এসে সব কিছু তছনছ করে ফেলে। তাদের সংসার ভেঙে যায়। আমীনও তার হাতছাড়া হয়ে যায়। সেই অনেক আগের স্মৃতিশুলো মোচড় মেরে ওঠে। ভাবতে থাকে তার আমীনকে নিয়ে। এবার একটু স্বাভাবিক হলেন ফাহিমা। কাছে ডাকলেন টোকাইকে। পথশিশুকে। কাছে এলো টোকাই।
কী নাম তোমার?
আমীন।
কী কর তুমি?
কিচ্ছু না।
পড় না?
না।
কেন?
ট্যাকা পামু কোনে?
তোমার বাবা নাই?
না।
মারা গেছেন?
না।
তাহলে?
কইতে পারিনা।
মানে?
জানিনা।
তোমার মা নাই?
আছে।
কী করেন তিনি?
জানিনা।
কী বলছ এসব। আমার সাথে ইয়ার্কি তাইনা!
না। ইয়ার্কি না।
কী তাহলে?
যা সত্যি তাই কইলাম।
কী সত্যি?
শুইনবার চান?
হ্যাঁ।
কমু তাইলে?
বল।
এবার পথশিশু তার জীবনের ইতিহাস বলা শুরু করল। বয়স কতই হবে! ছয় কী সাত। এই বয়সে কাছে বাবা নাই। মা থেকেও নাই। তার জীবন ইতিহাস ভিন্ন জগতের। অস্বাভাবিক। টোকাই ওর বক্তব্য বলা শুরু করল। ও বলছে-
আমি হেই সময় ছোটো। তেমন কিছুই বুঝি না। তবে এতটুকু বুঝি, বাপের অভাবের সংসার। দিন আনে দিন খায় অবস্থা। কোনদিন পেট বইরা বাত খাইবার পাইনা। মাছ গোশতও না। একটি ডিম খাইবার চাইয়া বাপের আতে মাইর খাইছি। সে অনেক মাইর। মায়ের আতেও হলাটির পিটন খাইছি। আমি ডিম খাইবার চাইলাম ক্যা, তার জন্যে বাবা মাহে মেলা পিটাইছে। নাটি দিয়া মাইরছে। মায়ের পিট ফাইটা গেছে। মেলা অক্ত পরছে মায়ের। মা মেলা কানছে। অনেক কষ্ট পাইছে মা। তাই মা আক কইরা আমাহে ফকিরের বাচ্চা কয়া গাইল দিছিলো। অনেক গাইলাইছিলো আমাহে। আমি মায়ের গাইল সইবার পারি নাই। আমিও তাই মাহে গাইল দিছিলাম। আমিও মাহে ফকিরের বেটি কয়া গাইল দিছিলাম। মা তাতে মেলা কষ্ট পাইছিল মনে। অনেক দুঃখ পাইছিল মা। আমি যহন মায়ের হাতে নাড়াই করি ঠিক তহন বাবা বাইত্তে আইসেন। বাবা আংগোরে নাড়াই হুইন্যা আবার মাহে মাইর দেন। আমাহেও মাইর দেন। মাইর খাইয়া মা বাবার হাতেও নাড়াই বাজাইয়া দেয়। অনেক নাড়াই করে। মা বাবাহেও ফকিরের বাচ্চা কইরা গাইল দেয়। মা বাবার কাছে বালোবালো খাইবার দিবার কয়। বালো কাপড় চায়। আমার জন্যও বালো কাপড় চায়। শীতের জামা চায়। মায়ের জন্যও অনেক কিছু চায়। মায়ের দাবি পূরণ করতে পারে না বাবা। তাই আবারো মায়ের হাতে নাড়াই বাজে বাবার। দুজনের সে কী নাড়াই। বাবা এবারও মাহে পিটায়। মায়েও বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। দুইজনের নাড়াই শেষে মা বাপের বাড়ি চইলা যায়। আর আইসে নাই এহনো। আমি নানাগরে বাইত্তে গেছিলাম মায়ের কাছে। মা আমাহে দাবড়াইয়া দিছে। মা কইছে আমি তোরে কামাই কইরা খিলাবার পারমুনা। আমি বাপের বাইত্তে খাই। অনেক কথা হুনতে অয়। বাইদের কতা। বাবিদের কতা। তাই তুই তোর বাপের কাছে থাকগা। মায়ের কতা হুইন্যা চইলা আইছি। বাবাও আমার হাতে আগাআগি করে। খুব খারাপ ব্যবহার করে। আমি তাই আক কইরা বাড়ি থেইকা চইলা আইছি।
এখন কী চাও তুমি?
কিচ্ছু না।
কেন?
জানিনা। তবে এইহানি কইবার পাই বাপ মায়ের আদর হারা ছেড়াছেড়িদের কেই দরদ করে না। বালোবাসে না। ওগোরে আপনজন বলতে কেই নাই। সমাজে ওদের জাগা নাই। দেশে ওদের নিরাপত্তার জন্য আইন আছে কিনা জানা নাই। তবে এইহানি জানি আমরা নাহি টোকাই। আংগোরে জাগা ব্যাহের পায়ের নীচে। নাটির নীচে।
তুমি ভুল বুঝেছ। তোমার ধারণা সঠিক নয়। আমরা তোমাদের জন্য কাজ করতে চাই। তোমাদের কল্যাণের জন্য এগিয়ে আসতে চাই আমিও।
এবা কিচ্ছু তো আমি দেহি না।
দেখবে এখন।
বালো কথা। দেকপার আশায় রইলাম।
বাসায় ফিরে আসেন ফাহিমা। অধিকার বঞ্চিত শিশুকিশোরদের কল্যাণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। যেই ভাবনা সেই কাজ। 'আদর্শ শিশুকল্যাণ সদন, নামে একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। যেখানে অনাথ অসহায় শিশুদের মানুষ করা হবে। টোকাইদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হবে। প্রথম অনাথ শিশু হিসেবে আমীনকেই ভর্তি করানো হয় তাঁর সদনে। বড় হতে থাকে আমীন। আমীনকে ভর্তি করানো হয় স্কুলে। স্কুলের নাম 'আদর্শ শিশুকল্যাণ শিক্ষা নিকেতন'। সদনের অধীনেই পরিচালিত হয় স্কুলটি। সফলভাবে প্রাইমারি জীবন শেষ করে আমীন। আবার ভর্তি করানো হয় হাই স্কুলে। এখানেও সে সফলতা অর্জন করে। কলেজ জীবন শেষে আমীন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
আমীন জানেনা তার সফলতার পিছনে এতো অবদান কার । ফাহিমার সাথেও দেখা নেই আমীনের। ফাহিমা ইচ্ছা করেই যোগাযোগ রাখেন না।
অনেক দিন পর। ফাহিমার খুব ইচ্ছা হয় আমীনকে দেখার। এতোদিনে আমীন অনেক বড় হয়েছে। যেমন বয়সে ঠিক তেমনই চেহারায়ও। আচার-আচরণেও। চাল-চলনেও তার অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন চেনাই যায় না যে আমীন এক সময় টোকাই ছিল।ফাহিমার সাথে আমীনের দেখা হওয়ার ব্যবস্থা করেন সদনের কর্মকর্তারা। কৌশলে আমীনকে ফাহিমার আবাসস্থলের পাশে নিয়ে যাওয়া হয় ঘুরতে। ফাহিমাও ঘুরছেন রাস্তায়। হাঁটছেন আনমনা হয়ে। ভাবুক হৃদয়ে! হাঁটতে হাঁটতে এক সময় দেখা হয় আমীনের সাথে। আমীন চিনতে পারে না ফাহিমাকে। ফাহিমা চিনতে না পারলেও ধারণা করেন এই ছেলেটিই আমীন হবে। আদর্শ ছেলে আমীন ফাহিমাকে সালাম করে। ফাহিমা সালামের জবাব দেন। আমীনকে উদ্দেশ্য করে তার অবস্থান জানতে চান ফাহিমা।
'আলহামদুলিল্লাহ' ভালো আছি বলে জবাব দেয় আমীন।
আমীনের পরিচয় জানতে চান ফাহিমা।
আমীন তার নাম পরিচয় বলে।
ফাহিমা জানতে চান সে কী করে?
আমীন বলে, পড়াশোনা করছি।
কোন ক্লাশে, জানতে চান ফাহিমা।
মাস্টার্স করছি।
আচ্ছা! কোথায়?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
'ভালো থেকো আমীন' বলেই ফাহিমা চলে যেতে উদ্যোত হলে আমীন ফাহিমার পরিচয় জানতে চায়। ফাহিমা তার পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আনমনা হয়ে দ্রুত সরে পরেন ফাহিমা। চোখ মুছতে মুছতে হনহন করে চলে যান তিনি। এগিয়ে যান সামনে। দ্রুত আমীনের আড়াল হন ফাহিমা। ফিরে যান বাসায়। আমীনকে নিয়ে ভাবেন তিনি। ভাবেন একান্ত আপনার করে। একান্ত নিজের করে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে। সুখের নদী বইতে থাকে ফাহিমার চোখে। স্বপ্ন চোখে। স্বপ্ন নদীতে। স্বপ্ন সাগরে।
স্বামী-সন্তান হারা ফাহিমার স্বপ্ন ছিল শিশুদের নিয়ে কাজ করার। অনাথ শিশুদের মানুষ করে গড়ে তোলার। আমীনকে দেখেই এমন একটি স্বপ্ন বুনেছিলেন তিনি। ফাহিমা আজ সফল। নেপথ্যে থেকে এরকম অনেক আমীনকেই মানুষ করতে পেরেছেন ফাহিমা।
ফাহিমার চলে যাওয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আমীন। আমীন ভাবে কে এই বিদুষী মহিলা! কেন সে এমন করছে তার সাথে! কেন! আমীন ভাবছেতো ভাবছেই। আমীনের ভাবনার শেষ কোথায়!
এপেক্স গ্যালারী, তৃতীয় তলা
পার্ক রোড, গাইবান্ধা।
০১৭১৯-২৫৭৬৩৪। 

Comments

Popular posts from this blog

শিশুতোষ গল্পঃ রাজকন্যা ও ব্যাঙ | মোনোয়ার হোসেন

খোকা আঁকে | তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন

গল্প : পিতার আর্তনাদ | কবির কাঞ্চন