গল্পঃ শরতের সকালে | মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর

পাখিদের কূজনে ঘুম ভাঙে জাহিদের। আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে সে। এপাশ-ওপাশ কাটতেই সালাতুল ফজরের আযানের সুর ধ্বনি কানে বাজে ওর। আর ঘুমাতে পারেনা জাহিদ। বিছানা ছেড়ে নেমে আসে রাস্তায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নদীর পাড়ে। যমুনার পাড়। এমন সকালে খালি পায়ে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা! নবম শ্রেণীর ছাত্র জাহিদ প্রতিদিনই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকে। আজও সে এগিয়ে এসেছে নদীর পাড়ে। যমুনার তীরে। নদীর তীরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন মনে। একান্ত হৃদয়ের জানালা খুলে। ঘুরে ফিরে দেখছে প্রকৃতির হাতছানি! স্নিগ্ধ সকালের কোমল পরশ! কাশফুলে ঘেরা যমুনার উদাস করা আকুলতা! নদীর কলতান! পাখিদের কুহুতান। সূর্যোদয়ের আবিলতা! জাহিদ এগিয়ে যায় সামনে। ক্রমাগত মঞ্জিলপানে। একটু এগুতেই চোখে পড়ে যমুনার ভাঙনের দৃশ্য। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বিঘা বিঘা ধানি জমি। জমির আবাদ। কৃষকের কলিজার ধন। বুকের মানিক। সবুজের স্বপ্নীল ছায়া। নিজের গ্রাম। গ্রামের মাটি। মাটির ফসল!


জাহিদের চোখে পড়ে যমুনার ভাঙনের ভয়ঙ্কর চিত্র। যমুনার গর্জনে আৎকে ওঠে জাহিদের কচি প্রাণ! কোমল হৃদয়! যমুনার ভয়ঙ্কর এ দৃশ্য ওকে খুব করে ভাবিয়ে তোলে। পীড়া দেয় অনেক বেশি করে। বেশ শক্তভাবে। বেদনার ক্ষত সৃষ্টি হয় ওর হৃদয়ের গহীণে। আত্মার গভীরে। নদী ভাঙ্গনের এ দৃশ্য দেখে জাহিদ ভাবে গরীবদের নিয়ে। এলাকার অসহায়দের নিয়ে। নদী ভাঙ্গন কবলিত মানুষদের নিয়ে। জাহিদ ভাবে-এই সেই যমুনা যার কড়াল গ্রাসে হারিয়ে গেছে ওদের বসতবাড়ি। বাপ-দাদার ভিটে-মাটি। ওদের প্রিয় গ্রাম। হারিয়েছে ওর প্রিয় বন্ধুদেরকে। খেলার সাথীদেরকে। পড়ার সহপাঠীদেরকে। ওর ছোট বোন সাজেদাও যমুনার পানিতে ডুবে ভেসে গেছে অজানার পথে। সাজেদা হারিয়ে গেছে চিরতরে। সে অনেক করে খোঁজে সাজেদাকে। একান্ত আপনার করে। এতোকরে খুঁজেও পায়নি তার লাশ। বোনের মৃতদেহ। সে নিশ্চিত সাজেদাকে আর পাবে না কোনদিন। জাহিদ আপন মনে ভাবতে থাকে এসব অনেক কিছুই। অনেক চিন্তাই ওকে ভাবাতে থাকে। তাড়িত করে। এসব ভাবতেই জাহিদের মনে পড়ে সালাতুল ফজর আদায় হয়নি এখনও। জাহিদ আকুল প্রায়! এখন ওর মনটা আর যমুনার পাড়ে নেই। যমুনার মায়াবী সব আকর্ষণ আর বেদনার নীল সাগর ভুলে যেতে বসেছে জাহিদ। সালাতুল ফজর আদায় করাই ওর প্রধান কাজ এখন। রবির উদয় ঘটলেই কাযা হবে সালাতুল ফজর। কি আর করা! সময় খুবই কম। তাই যমুনাতেই অযু সেরে নেয় জাহিদ। সালাত আদায় করতে মসজিদপানে এগিয়ে যায় সে।
ফজরের সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করে জাহিদ। সালাত শেষে বাড়িতে ফিরে আসে ও। পড়ার টেবিলে বসে কুরআন আর হাদিস অধ্যয়নে মন দেয় সে। এখন সুরা আর রাহমান অধ্যয়ন করছে সে। একেকটি আয়াত তেলাওয়াত করছে আর ভাবছে। ভাবছে আর যেন হারিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। অন্য কোন জগতে! জাহিদ ভাবছে আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য নেয়ামতের কথা! মহান রবের সৃষ্টিরাজির কথা! "তোমরা আল্লাহর কোন কোন নেয়ামাত করবে অস্বীকার" আয়াতের ভাবার্থ ভাবতেই সেজদায় অবনত হয়ে পড়ে সে। নুয়ে পরে তার মস্তক। পাঠ্যবই পড়ার কথা খেয়াল থেকে হারিয়ে যায় ওর। জাহিদ স্বরণ করে অসংখ্য নেয়ামতের কথা। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার কথা! তাঁর দয়ার কথা! দানের কথা!
জাহিদ এবার পড়ায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করছে বেশ জোড়ালোভাবে। দায়িত্ববোধের সাথে। একান্ত চিত্তে। এতো চেষ্টার পরেও জাহিদের পড়ায় মন বসছে না। কিছুতেই না। ওর মনটা চলে যাচ্ছে বাইরে। অন্য কোথাও। অন্য কোন জায়গায়! অন্য কোন পাড়ায়! অন্য কোন জমিনে! আনমনা জাহিদ এসব কিছু ভাবতেই তালরসের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে ওর নাকে। সে তন্ময় হয়ে ভাবে, এতো সকালে তালরসের গন্ধ আসে কোথেকে! জাহিদ ভাবে একান্ত আপনার করে। হৃদয়ের একান্ত অনুভূতি দিয়ে। ওর ভাবনা, বাবা হয়তো গতকাল বাজার থেকে তাল কিনে এনেছেন। সঠিক হয় জাহিদের ভাবনা। গতকাল ওর বাবা বাজার থেকে তাল কিনে এনেছেন। বেশ টসটসে পাঁকা ছিলো তালগুলো। গতরাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কারণে ওর জানা হয়নি তালের খবর। পিঠা বানানোর খবর।
গত দুদিন হয় ওর দুলাভাইয়েরা বেড়াতে এসেছেন। অনেক দূরের গাঁয়ে থেকে এসেছেন তারা। কেউবা শহর থেকেও এসেছেন। জামাই বলে কথা! মৌসুম উপযোগী ফলের পিঠা খাওয়াতে হবে তাদেরকে। এখন ভাদ্র মাস। তাই তালের পিঠাই খাওয়ানো দরকার। এজন্যই তাল কিনে এনেছেন বাবা। রাতে পিঠাও বানিয়েছেন মা এবং বোনেরা। হাড়িভর্তি পিঠা। তালের পিঠা। পিঠার মিষ্টি গন্ধে জাহিদের মন চলে যায় বাইরে। আর ঘরে মন বসেনা ওর। এবার সে ছুটে আসে মায়ের কাছে। বসে মায়ের পাশে। মায়ের জান্নাতী কোলের কাছে। মা পাকেরঘরে রান্না করছেন। সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত তিনি।
জাহিদ তুমি বাইরে কেন বাবা? সকালে পড়তে বসনি আজ? জানতে চাইলেন মা সুমাইয়া সুলতানা।
জ্বী, পড়তে বসেছিলাম। কুরআন আর হাদিস অধ্যয়ন শেষ করেছি মাত্র। ক্লাশের পড়া শুরু করতেই তাল পিঠার গন্ধ পেলাম। তাই বাইরে এলাম৷ তোমার কাছে। তোমার কোলের পাশে। বাবা গতকাল বাজার থেকে তাল এনেছেন বুঝি!
হ্যাঁ। গতকাল তোমার বাবা বাজার থেকে তাল কিনে এনেছেন। সারারাত জেগে সেই তালের পিঠা বানিয়েছি আমরা। তুমি গতরাতে সকাল সকাল ঘুমিয়ে যাওয়ায় আর ডাকা হয়নি তোমাকে। এছাড়া পড়ার ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে সকালেও ডাকিনী এখনও।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ, তাই।
তাহলে পিঠা খেতে দাও আমাকে।
দেব নিশ্চয়ই। তবে-
তবে আবার কী?
তবে আর কিচ্ছু না। জানতে চাই তোমার কি
পরীক্ষা আছে আজকে ?
আরবি সাহিত্য প্রথম পত্র।
ঠিক আছে। তুমি তাহলে পিঠা খেয়ে পড়তে বস। পরীক্ষার পড়াগুলো আরেকবার দেখে নাও।
হ্যাঁ, আমি তাই করছি মা। তাহলে আমাকে পিঠা খেতে দাও। পিঠা খেয়েই পড়তে বসব।
বসো। এই নাও- বলেই মা জাহিদকে কয়েকটি তালের পিঠা খেতে দিলেন।
জাহিদ মজা করে পিঠা খেয়ে নেয়। এবার পড়ার কক্ষে ফিরে আসে ও। আবারো পরীক্ষার পড়ায় মনোযোগী হয় জাহিদ। ওদের দ্বিতীয় সাময়িকী পরীক্ষা চলছে। ছাত্র হিসেবে সে খুব ভালো। পিএসসিতে এবং জেএসসিতে গোল্ডেনপ্লাস বৃত্তি পেয়েছিল জাহিদ। এলাকার সবাই ওকে ভালো জানেন। একজন চরিত্রবান ছেলে হিসেবে জাহিদের বেশ পরিচিতিও আছে।
এই কিশোর বয়সেই সে সালাতের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল। নিয়মিত মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করে। নিয়মিত কুরআনও তেলাওয়াত করে জাহিদ। কভুও মিথ্যা বলে না কারো সাথে। খারাপ আচরণও করে না অন্যের সাথে। ক্ষতি করে না কোন ব্যক্তির। কোন পশু-পাখিরও ক্ষতি করে না সে। তাই পাড়ার সকলেই জাহিদকে খুব আদর করেন। ভালোবাসেন। স্নেহ করেন। স্কুলেও জাহিদ সকলের প্রিয় বন্ধু। স্যারদের কাছেও সবচেয়ে আদরের ছাত্র সে। জাহিদের ইচ্ছা ও অনেক বড় হবে। নামে নয় কামে এবং গুনে। সত্যিকারের মানুষ হওয়ার ইচ্ছা তার। জগত বিখ্যাত মনীষীদের জীবন থেকে সে শিক্ষা নিতে চায়। জাহিদ আমরণ সত্যের পথে চলতে চায়। দ্বীনে হকের প্রতি ডাকতে চায় তরুণদেরকে। পথভোলা কিশোরদেরকে। সত্য ও সুন্দরের পথে সহপাঠীদেরকে ডাকবার প্রেরণা ওকে বারবার দোলা দেয়। প্রেরণা জোগায়।
জাহিদ বেশ ভাবুক হৃদয়ের ছেলে। বেশ সমাজ সচেতন। দেশের প্রতি তার ভালোবাসা অনেক গভীরে। দেশপ্রেমকে সে ঈমানের দাবি মনে করে। দেশপ্রেমকে নিজের অন্যতম একটি দায়িত্ব ভাবে সে। তাই বর্তমান সময়ের বিপথগামী ছাত্রসমাজের চালচলন ওকে ভাবিয়ে তোলে। বেশ করে ভাবায়। অনেক করে কচি মনের গহীণে আঘাত হানে। বেশ শক্ত করে। কঠিনভাবে। বর্তমানের লেজুরবৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ওকে খুব করে পীড়া দেয়। অনেক কষ্ট দেয় কোমল মনে। সহজ সরল হৃদয়তন্ত্রীতে! ওর সুভাবনায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এসব অনৈতিকতা। মানবতার এ বিপর্যয় ওকে ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে দেয়। গভীর থেকে গভীরে। গভীর অরণ্যে হারিয়ে যায় জাহিদ। সে ভাবে আপন মনে। একান্ত আপনার করে। ভালোবাসার হৃদয় দিয়ে। হৃদয় জমিনের সবুজাভাব দিয়ে। জাহিদ ভাবে- আমরা কেন সাদা কাশফুলের মতো একসাথে চলতে পারছিনা! সাদা মেঘের ভেলার মতো আমরা কেন উদার হচ্ছিনা! আমরা আজ কেন সত্য এবং সুন্দরকে গ্রহণ করতে পারছিনা আপনার করে! একান্ত নিজের করে। ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে! আমরা কেন পরের কল্যাণে এগিয়ে আসছিনা অকাতরে! আমরা কেন একে অপরের পাশে সহযোগী হয়ে দাঁড়াচ্ছিনা!  জীবনবোধকে জাগ্রত করে আমরা কেন মানব কল্যাণে ভুমিকা রাখছিনা! একান্ত হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে জাহিদ এসব ভাবতে থাকে। সাদা কাশফুলের মতো শুভ্র এসব ভাবনা জাহিদের। শুধুই কী জাহিদের ভাবনা হবে এসব! নাকি আমাদেরও হতে হবে? শরতের এই স্নিগ্ধ সকালে জাহিদের ভাবনাগুলোর শেষ কোথায়! 
এপেক্স গ্যালারী, তৃতীয় তলা
পার্ক রোড, গাইবান্ধা।
০১৭১৯-২৫৭৬৩৪। 

Comments

Popular posts from this blog

শিশুতোষ গল্পঃ রাজকন্যা ও ব্যাঙ | মোনোয়ার হোসেন

খোকা আঁকে | তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন

গল্প : পিতার আর্তনাদ | কবির কাঞ্চন